, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫ , ১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​ইরানে মোসাদের 'রাইজিং লায়ন' অভিযান: গুপ্তচরবৃত্তি, ড্রোন ঘাঁটি ও ট্রাম্পের প্রকাশ্য সমর্থনে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য

  • আপলোড সময় : ১৬-০৬-২০২৫ ১০:৩০:৫৩ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৬-০৬-২০২৫ ১০:৩৬:৩৪ পূর্বাহ্ন
​ইরানে মোসাদের 'রাইজিং লায়ন' অভিযান: গুপ্তচরবৃত্তি, ড্রোন ঘাঁটি ও ট্রাম্পের প্রকাশ্য সমর্থনে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পেয়েছে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক 'রাইজিং লায়ন' অভিযানের মধ্য দিয়ে। এই অভিযানে মোসাদের নেতৃত্বে ইরানের ভেতরে ঢুকে সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় নজিরবিহীনভাবে আঘাত হানা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে পরিচিত মোসাদ কীভাবে একাধিক বছর ধরে এই অভিযানকে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, কীভাবে ইরানের ভেতরে ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং কৌশলগত জায়গায় অস্ত্র বসিয়ে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করেছে—সবই উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে।
 
সেইসঙ্গে এই অভিযানে মোসাদের হুমকির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন খোদ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, “তারা সবাই এখন মৃত।” এই বক্তব্য একদিকে যেমন ইরানে ক্ষোভের আগুন বাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি মার্কিন প্রশাসনের ইসরাইল ঘেঁষা নীতির আরেকটি উদাহরণ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
 
মোসাদের অভিযান ‘রাইজিং লায়ন’ মূলত একটি বহুপদক্ষেপে গঠিত পরিকল্পনা, যার প্রথম ধাপকেই ‘নির্মূল অভিযান’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই ধাপের মধ্যেই ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতা, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি এবং ভূগর্ভস্থ বাংকারে আঘাত হানা হয়। ইসরাইলি নিরাপত্তা সূত্র জানায়, মোসাদ বহু বছর ধরে ইরানের শীর্ষ নেতাদের বাসা, বাংকার ও গোপন আশ্রয়স্থলের বিস্তারিত তথ্য সংবলিত ফাইল তৈরি করে। এ সকল তথ্য সংগ্রহে তারা আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এবং লোকাল গুপ্তচরদের সহায়তা নেয়।
 
মোসাদের এই অভিযানে সবচেয়ে নজরকাড়া দিক ছিল ইরানের ভেতরেই অস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন এবং ড্রোন লঞ্চার প্রস্তুত করা। দ্বিতীয় এক ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করার লক্ষ্যে তারা খোলা জায়গায় উচ্চ-নির্ভুল অস্ত্র স্থাপন করে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যাটারি ছিল, ঠিক তার আশেপাশেই। উদ্দেশ্য ছিল—হামলার ঘণ্টা কয়েক আগে এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা।
 
এর পাশাপাশি ইরানের এসফাজাবাদ এলাকায় স্থাপন করা হয় বিস্ফোরক ড্রোনের ঘাঁটি। সেখান থেকেই ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলোতে আঘাত হানা হয়। এমনকি সাধারণ যানবাহনের ভেতর লুকানো ছিল উন্নত বিস্ফোরক ও প্রযুক্তি, যেগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করা হয়।
 
একজন প্রথম সারির ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানান, মোসাদের অভিযানে একটি বিশেষ লক্ষ্য ছিল ক্ষেপণাস্ত্র পরিবহনকারী ট্রাক। প্রতিটি ট্রাক ধ্বংস করা মানে চারটি করে ক্ষেপণাস্ত্রের কার্যকারিতা শেষ করে দেওয়া। এই ধরনের কৌশলিক পদক্ষেপ ইরানের সামরিক সক্ষমতা মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম হয়।
 
এই সবকিছুই যেন পূর্ব পরিকল্পিত এক চিত্রনাট্যের মতো কার্যকর হয়েছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এমন গভীর অনুপ্রবেশ ও সমন্বিত আক্রমণের ফলে বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা বিশ্বদরবারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
 
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই আক্রমণের আগেই ইসরায়েল গোপনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র আমদানি করে। যা ইরানে ব্যবহার করা হয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টার্গেট ধ্বংসে। মার্কিন সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া এই ধরনের অভিযানের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেই মনে করেন সামরিক বিশ্লেষকরা।
 
এই পুরো অভিযানের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে আরও আলোচিত হয় যখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি মোসাদের হুমকিকে সমর্থন করেন। নিহত ইরানি নেতাদের উদ্দেশ্যে তাঁর মন্তব্য, “তারা সবাই এখন মৃত”—এটি ইরানের জন্য ছিল অপমানজনক এবং যুদ্ধ উসকে দেওয়ার মতো স্পষ্ট হুমকি। তিনি আরও সতর্ক করেন যে, যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যায়, তাহলে আরও ভয়াবহ হামলা আসবে।
 
ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনাময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও আগেই নিষ্ক্রিয় করা হয়। ড্রোন ও বোমা বহনকারী গাড়িগুলোর মাধ্যমে এসব প্রতিরক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধ্বংস করা হয়। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী যখন বুঝে ওঠার আগেই হামলা শেষ হয়ে যায়।
 
মোসাদ এই আক্রমণের ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায় ড্রোন দিয়ে আঘাত হানার মুহূর্ত। ভিডিওগুলোতে স্পষ্টভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংস হওয়া এবং ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য ধরা পড়ে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি একধরনের ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’—যার মাধ্যমে শত্রুর মনোবল ভেঙে ফেলা হয়।
 
তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন শহরে মোসাদের গোপন নেটওয়ার্ক কাজ করেছে। তাদের সহযোগিতায় এই পরিকল্পনা দীর্ঘদিন ধরে গোপনে গড়ে তোলা হয়। মোসাদের সাবেক উপ-প্রধান রাম বেন বারাক বলেন, “এই সফলতার পেছনে রয়েছে এমন এক ইরান সরকার, যার ওপর জনগণের বিশ্বাস কমে গেছে। ফলে গুপ্তচর প্রবেশ সহজ হয়েছে।”
 
এর আগেও গাজায় যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েল হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করে। বলা হয়, ওই হামলার ক্ষেত্রও পূর্বে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। একই কৌশল প্রয়োগ করা হয় ইরানে। একে একে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ব্যক্তি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশানা করা হয়।
 
মোসাদের এই অভিযান মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—ইরান এর জবাবে কী করবে? সিএনএন এবং টাইমস অব ইসরায়েল বলছে, ইরানও ইসরায়েলে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাতে হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।
 
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘রাইজিং লায়ন’ ছিল শুধু একটি শুরু। এর মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানকে একধরনের চূড়ান্ত বার্তা দিল—যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো স্থানে তারা আঘাত হানতে প্রস্তুত। একে মধ্যপ্রাচ্যের ‘ছায়াযুদ্ধের’ নতুন রূপ বলছেন কেউ কেউ।

নিউজটি আপডেট করেছেন : নিজস্ব প্রতিবেদক

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
বাংলাদেশের সামুদ্রিক ভবিষ্যৎ কি পেশাগত মানহানির পথে হাঁটছে?

বাংলাদেশের সামুদ্রিক ভবিষ্যৎ কি পেশাগত মানহানির পথে হাঁটছে?